দ্বিতীয় স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে সাজা দেয়া নজিরবিহীন : একুশে আগস্ট মামলার আইনজীবী
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে সাজা দেয়ার নজির নেই। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি পক্ষের অন্যতম আইনজীবী এডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির আজ রায় পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় এ কথা বলেন। তিনি বলেন, '৪০০ বছরের ইতিহাসে ভারতীয় সাবকন্টিনেন্টে দ্বিতীয় স্বীকারোক্তির উপর ভিত্তি করে কাউকে সাজা দেয়া হয়েছে আর কোন নজির নেই।'
তিনি বলেন, এ মামলার আসামি মুফতি হান্নান দু’বার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। টর্চার করে তার কাছ থেকে দ্বিতীয় স্বীকারোক্তি আদায়ের অভিযোগ ছিল। দ্বিতীয় স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করেছিলেন তিনি। এ স্বীকারোক্তির কোন আইনগত ভিত্তি নেই একথা আমরা আদালতে বলেছি। এডভোকেট শিশির মনির বলেন, বিচারিক আদালত এ মামলায় ৪৯ জনকে সাজা দিয়েছিলেন। এরমধ্যে ১৯ জনকে মৃত্যুদন্ড, ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অন্যান্যদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়ে রায় দিয়েছিল।
তিনি বলেন, বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত আপিলের শুনানি শেষে সকলের আপিল মঞ্জুর (এলাউড) করেছেন উচ্চ আদালত। বিষয়টি নিয়ে ইতোপূর্বে জারি করা রুল এবসিলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করেন আদালত। সকলকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, রায়ে নিম্ন আদালতের ট্রায়ালকে অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। আইনের ভিত্তিতে বিচারিক আদালতে বিচার (ট্রায়াল) কার্যক্রম হয়নি। বিচারিক আদালতে দেয়া এক সাক্ষীর সাথে অন্য সাক্ষীর সাক্ষ্যে কোন সামঞ্জস্যতা (কোলাবরেশান) নেই। এ ধরনের কেইস-এ ঘটনা পরস্পর দেখেছেন এমন কোন সাক্ষ্য নেই।
একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সব আসামিকে বেকসুর খালাস দিয়ে আজ রায় ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। বিচারিক আদালতের রায় বাতিল করে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত একটি হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ আজ এ রায় ঘোষণা করেন। এর আগে চার দিন আপিলের ওপর শুনানি হয়।
বিচারিক আদালত এ মামলায় ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছিল। রায়ে আদালত বলেছেন, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার ছিল অবৈধ। আইনে এটা টেকে না। রায়ে বলা হয়েছে, যে চার্জশিটের ভিত্তিতে নিম্ন আদালত বিচার করেছিলেন তা আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এর আগে বেলা ১১টায় রায় ঘোষণা শুরু হয়। ১১টা ৪৫ মিনিটে রায় পড়া শেষ হয়। রায়ের মূল অংশ পাঠ করেন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান।
আদালতে আসামিদের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী এস এম শাহজাহান ও আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। তারা এই মামলা শুরু থেকে আসামিপক্ষে শুনানি করেছেন। আদালতে বিএনপির আইনজীবীদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, ব্যারিস্টার মো. রুহুল কুদ্দুস কাজল, এডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল, এডভোকেট আমিনুল ইসলাম প্রমূখ।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর গ্রেনেড হামলা ও হত্যা মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে ফাঁসি এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপি নেতা কাজী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। পরে ওই বছরের ২৭ নভেম্বর মামলার বিচারিক আদালতের রায় প্রয়োজনীয় নথিসহ হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় এসে পৌঁছায়।
নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যে ১৯ আসামি খালাস পেলেন : সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ, মাওলানা তাজউদ্দীন, মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মাওলানা শেখ ফরিদ, মাওলানা আবু সাইদ, মুফতি মঈনউদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল, হাফেজ আবু তাহের, মো. ইউসুফ ভাট ওরফে মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক, মফিজুর রহমান ওরফে মহিবুল্লাহ, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হোসাইন আহমেদ তামিম, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ও মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন।
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত যে ১৯ আসামি খালাস পেলেন: শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ ওরফের আবু ওমর, আবু হোরাইরা ওরফে পীরসাহেব, মাওলানা সাব্বির আহমদ ওরফে আবদুল হান্নান সাব্বির, আরিফ হাসান ওরফে সুজন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, আবু বকর ওরফে সেলিম হাওলাদার, মো. আরিফুল ইসলাম ওরফে আরিফ, মহিবুল মোত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন, আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন, মো. খলিল, জাহাঙ্গীর আলম বদর ওরফে ওস্তাদ জাহাঙ্গীর, মো. ইকবাল, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন্, তারেক রহমান ওরফে তারেক জিয়া, হারিছ চৌধুরী (প্রয়াত) কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই এবং রাতুল আহম্মেদ বাবু ওরফে বাবু ওরফে রাতুল বাবু।
একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়ের হওয়া দুই মামলার রায়সহ প্রায় ৩৭ হাজার ৩৮৫ পাতার নথি ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এসে পৌঁছায়। পরে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানির জন্য মামলার পেপারবুক তৈরির নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। সেই আদেশের ধারাবাহিকতায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাড়ে ১০ হাজার পৃষ্ঠার পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়। আসামিদের মধ্যে ২২ জন খালাস চেয়ে আপিল করেছেন। অপরদিকে ১২ জন আসামির জেল আপিল দায়ের হয়েছে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলা-বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কয়েকশ নেতা-কর্মী। এ মামলায় বিএনপি'র শীর্ষ নেতৃত্বকে সম্পৃক্ত করা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে বারবার দাবি করে আসছিল দলটি। আজ রায়ে সেটিই প্রমাণ হলো বলে দাবি করেছেন আইনজীবীরা। তারা রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হল।