খাদ্য সিন্ডিকেট ভাঙতে হুমকির মুখে সচিব, মাঠে শামীম ওসমানের লোকজন

Nov 10, 2024 - 18:54
খাদ্য সিন্ডিকেট ভাঙতে হুমকির মুখে সচিব, মাঠে শামীম ওসমানের লোকজন

মিয়াদ হোসেন

খাদ্য সেক্টরের বেজায় দাপুটে সিন্ডিকেট ভাঙ্গার উদ্যোগ নেওয়ায় খোদ খাদ্য সচিবই বিপাকে পড়েছেন। সিন্ডিকেটের হুমকির মুখে রয়েছেন তিনি। গেল অক্টোবরে নিয়োগ পাওয়া সচিব মো. মাসুদুল হাসানকে বিতর্কিত করার মাধ্যমে হটিয়ে দিতে উল্টো সিন্ডিকেট সদস্যরাই জোট বেধেছে। তারা মতিঝিলে প্রভাবশালী এক খাদ্য ঠিকাদারের অফিসে গোপন বৈঠক করে সচিব হটাতে দশ কোটি টাকার তহবিল পর্যন্ত গঠন করেছে। ওই তহবিলের টাকায় বিভিন্ন মিডিয়ায় একের পর এক সংবাদ প্রকাশ করে খাদ্য সচিবকে বিতর্কিত করাসহ উচ্চ আদালতে রীট দাখিলের মাধ্যমে বেকায়দায় ফেলারও সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সচিব মো. মাসুদুল হাসান খাদ্য মন্ত্রনালয়ে দায়িত্ব পেয়েই সিন্ডিকেট বিরোধী নানা আদেশ নির্দেশ জারি করায় সোহাগ-জসিম-সাধনদের মতো দশটিরও বেশি সিন্ডিকেট চরম বিপাকে পড়ে। এসব চক্র বছরের পর বছর ধরে খাদ্য অধিদপ্তরসহ মন্ত্রনালয়কে জিম্মি করে নিজেদের খেয়াল খুশি মতো খাদ্য সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। সচিবের কঠোর ভূমিকায় খাদ্য সরবরাহকারী মিল মালিক চক্রের অপকর্মও ফাঁস হয়ে গেছে, বেরিয়ে এসেছে ডিলার চক্রেরও নানা কারসাজি। এমন পরিস্থিতিতে গত ৮ নভেম্বর রাতে অভিযুক্ত সিন্ডিকেট ব্যবসায়িরা মতিঝিলে গোপন বৈঠকে বসে। বরাবরই আওয়ামী ঘরানার ঠিকাদার ও মিল মালিকরা সিন্ডিকেট গড়লেও তাদের চক্রান্ত সফল করতে এবারই প্রথম বিএনপি সমর্থক দুই ঠিকাদারকে সিন্ডিকেটভুক্ত করার তথ্য পাওয়া গেছে। বিএনপি ব্যানারের দুই ঠিকাদারকে সামনে নিয়ে শামীম ওসমানের গড়া সোহাগ-জসিম সিন্ডিকেট খাদ্য সেক্টরকে লুটপাটের আখড়া বানাতে চায় বলেও অভিযোগ উঠেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বর্তমান খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাসুদুল হাসান ও খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আব্দুল খালেক দায়িত্ব নেওয়ার পর খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তরের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন নতুন সচিবের নানা উদ্যোগের ফলে দীর্ঘদিন পর সিন্ডিকেট মুক্ত হলো নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা মহানগরসহ অন্যান্য জেলার বেসরকারি ময়দার মিলের গম বরাদ্দ। ২০২২ সালের পর এই প্রথম বেসরকারি ময়দার মিলে সরকারি গম বরাদ্দ নীতিমালা ২০২২ (সংশোধিত) কার্যকর হয়েছে।

গত ৩ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে খাদ্য সচিব হিসেবে যোগদান করেন মো. মাসুদুল হাসান। যোগদানের পরই সরকারি নীতিমালা অনুসরণ করে তিনি বেসরকারি ময়দার মিলের সরকারি গম বরাদ্দ এবং চাল, আটা বিক্রিও অনুমোদন প্রদান করেন। একইসঙ্গে ইতিপূর্বে জারিকৃত সকল পরিপত্র বাতিল করে নীতিমালা অনুযায়ী ঢাকা মহানগরসহ অন্যান্য জেলায় তালিকাভুক্ত ময়দার মিলগুলোকে গম বরাদ্দের আদেশ জারি করেন। খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আব্দুল খালেক গত ৩১ অক্টোবর সচিবের জারিকৃত চিঠি সকল জেলায় প্রেরণ করেছেন।

সাবেক খাদ্য সচিব ইসমাইল হোসেন ২০২২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বেসরকারি ময়দার মিলে সরকারি গম বরাদ্দ নীতিমালা ২০২২ প্রণয়ন করেছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে নীতিমালা প্রণয়ন করেও নীতি বহির্ভুত কাজ করেছেন, সকল ক্ষেত্রেই খাদ্য সিন্ডিকেটের একচেটিয়া সুবিধা নিশ্চিত করেছেন। নারায়নগঞ্জের শামীম ওসমান ও তার দোসর সোহাগ ছাড়া খাদ্য অধিদফতরে আর কোন ব্যবসায়ী বা মিল মালিক খাদ্য অধিদপ্তরে প্রবেশও করতে পারতো না। অভিযোগ রয়েছে, সাবেক খাদ্য সচিব বিপুল পরিমাণ আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে নারায়ণগঞ্জের মিল মালিকদের অনৈতিকভাবে গম বরাদ্দের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। যা নীতিমালা পরিপন্থি ও বেআইনি কাজ ছিল। সাবেক খাদ্য সচিবের এমন কর্মকান্ডে অন্যান্য মিল মালিকরা মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হন। এরপরও তারা টু শব্দটি পর্যন্ত করতে সাহস পেতেন না। ২৯ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে খাদ্য সচিব নভেম্বর ২০২৪ এর চাল আটা বিক্রির অনুমোদন প্রদান করেন। "বেসরকারী ময়দার মিলসমূহে সরকারী গম বরাদ্দ নীতিমালা ২০২২ (সংশোধিত)" আবশ্যিক ভাবে অনুসরণ করার শর্তও জুড়ে দেওয়া হয়। এরপর বিভিন্ন ভাবে গড়িমসি ও সময়ক্ষেপণ করেও শেষ রক্ষা হয়নি, সচিবের কঠোর ভূমিকা ও নজরদারির কারণে ০৬ নভেম্বর ঢাকা মহানগরসহ অন্যান্য জেলায় গম বরাদ্দ দিতে হয়েছে। কিন্তু স্বচ্ছতার সাথে এ বরাদ্দ প্রদানের বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না খাদ্য অধিদপ্তরের সরবরাহ, বন্টন ও বিপনন বিভাগের কর্মকর্তারা।

সিন্ডিকেটের আজ্ঞাবহ পরিচালক মোঃ আব্দুস সালাম (সরবরাহ, বন্টন ও বিপনন) আগেরদিন অর্থাত ৫ নভেম্বর 'অতীব জরুরি' হিসেবে বিভ্রান্তিমূলক চিঠি পাঠান ঢাকা মহানগরসহ শ্রমঘন জেলার খাদ্য কর্মকর্তাদের কাছে। এতে নারায়নগঞ্জ জেলার কতিপয় মিলে (সিন্ডিকেট সদস্যদের মালিকানাধীন) সরকারি গম বরাদ্দ দেওয়া যাবে কি না সে বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়। পাশাপাশি টেলিফোন নির্দেশনায় ঢাকা রেশনিংসহ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের নারায়নগঞ্জের মিলসমূহে সরকারি গম বরাদ্দ দেওয়ার পক্ষে মতামত প্রদানে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছে। খাদ্য সেক্টরকে টানা ১৭ বছর যাবত কজা করে রাখা সোহাগ-জসিমের নারায়নগঞ্জ সিন্ডিকেটের মিলসমূহে সরকারি গম বরাদ্দ দেওয়ার জন্য 'অতীব জরুরি' চিঠি কেন- তা নিয়ে সকল মহলে প্রশ্ন উঠেছে।

শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে সোহাগ-জসিম সিন্ডিকেটের বাইরে কোনো মিল মালিক, খাদ্য ঠিকাদার এমনকি ডিলার পর্যন্ত খাদ্য অধিদপ্তরের ধারে কাছে ঘেষতে পারেন না। তাদের আঙ্গুলী নির্দেশনা ছাড়া খাদ্য সেক্টরের টুকিটাকি সাপ্লাইয়ের কাজও কারো ভাগ্যে জোটে না। সেই দাপুটে সিন্ডিকেটই পুনরায় সরকারি বরাদ্দের সিংহভাগ গম নারায়নগঞ্জের মিলসমূহের জন্য বাগিয়ে নিলে সারাদেশে চরম অসন্তোষ সৃষ্টি হবে। সারাদেশের সাধারন মিল মালিকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, এবারও শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ সিন্ডিকেটকে খাদ্য নীতিমালা ভঙ্গ করে গম বরাদ্দের পাঁয়তারা চালানো হলে তারা প্রধান উপদেষ্টার সরনাপন্ন হতে বাধ্য হবেন।

ধারাবাহিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মিল মালিকসহ ঠিকাদাররা অভিযোগ করে জানান, গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পরও সাবেক খাদ্য সচিব ইসমাইল হোসেন এনডিসি শামীম ওসমানের সহযোগী ব্যবসায়ীদের মিলগুলোতে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসেরও গম বরাদ্দ দিয়েছেন। দুর্নীতিসহ নানা অপকর্মের কারণে খাদ্য সচিব ইসমাইল হোসেনকে অব্যাহতি দেওয়া হলেও তার অবৈধ আদেশসমূহ যথারীতি নহাল রাখা হয়েছে।

এ সিন্ডিকেটের কারনে গত ১৭ বছর কোন ব্যবসায়ী সরকারী গম বরাদ্দ ঠিকমত নিতে পারেনি। তারা নারায়নগঞ্জের মিলগুলোর নামে বরাদ্দ নিয়ে উন্নতমানের সরকারী গম কালোবাজারে বিক্রি করে দেন এবং নিম্নমানের পশুখাদ্যের গম দিয়ে আটা বানিয়ে কিছু আটা প্রদান করেন ও বাকী আটা ডিলারের সাথে সমন্বয় করেন। এ গম চুরি নিয়ে সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা মোঃ জসিমের নামে দুদকে ৫০০ কোটি টাকার সরকারী গম চুরির তদন্ত চলমান রয়েছে। এরপরও খাদ্য অধিদপ্তর ওই অভিযুক্তদের অনুকুলেই কেন সরকারি বরাদ্দের সুবিধা দিতে চায়?

অভিযোগ রয়েছে, সিন্ডিকেট সদস্যরা একচেটিয়া বরাদ্দ হাতিয়ে নেওয়ার বিনিময়ে খাদ্য অধিদপ্তরের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে কোটি কোটি টাকা প্রদান করে থাকে। অনেক কর্মকর্তাকে দামি গাড়ি, ঢাকায় প্লট-ফ্ল্যাট উপহার দেওয়া ছাড়াও প্রতি বছর স্বপরিবারে ইউরোপ-আমেরিকায় অবকাশ যাপন, সন্তানদের বিদেশে পড়াশুনার খরচ, মেডিকেল চেকআপ করানোসহ নানারকম দায়িত্ব পালন করে সিন্ডিকেট। এসব সুবিধা হাতছাড়া না করতেই অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মন্ত্রী-সচিবের নির্দেশকেও পাত্তা দেয় না। তাদের চাকরি ক্ষেত্রে কোনো ঝুট ঝামেলা হলেও সিন্ডিকেট সদস্যরা যে কোনো মূল্যে তা মিটিয়ে থাকেন বলেই দিন দিন তারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।