আলেপ্পোর অধিকাংশ এলাকা বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে
জিহাদি নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহীরা আলেপ্পোর অধিকাংশ স্থান দখল করার পর শনিবার সিরিয়ার দ্বিতীয় প্রধান শহরটির বিমানবন্দর ও এর আশপাশের কয়েকটি শহর দখল করে নিয়েছে। একটি যুদ্ধ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা একথা জানিয়েছে। দামেস্কের মিত্র মস্কো ২০১৬ সালে আলেপ্পোতে প্রথম বিমান হামলা চালানোর পর থেকে সরকারের পক্ষে সেখানে মোতায়েন রয়েছে। এদিকে জিহাদিরা ও তাদের তুর্কি-সমর্থিত মিত্ররা প্রতিবেশী লেবাননে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার সাথে সাথে বুধবার সিরিয়ায় আক্রমণ শুরু করেছে।
তার এমিরাতি প্রতিপক্ষের সাথে টেলিফোনে, প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ‘সন্ত্রাসীদের’ যত বড় আক্রমণই হোক না কেন- তা প্রতিহত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস অনুসারে, সাম্প্রতিক সংঘর্ষে কমপক্ষে ৩২৭ জন নিহত হয়েছে। যাদের বেশিরভাগই যোদ্ধা। তবে নিহতদের মধ্যে ৪৪ জন বেসামরিক নাগরিকও রয়েছে। ব্রিটেন ভিত্তিক যুদ্ধ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাটি আরো জানায়, ‘হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) ও এর সহযোগী দলগুলো বড় ধরনের প্রতিরোধের মুখোমুখি না হয়েই শহরটির বেশিরভাগ এলাকা, সরকারি কেন্দ্র ও কারাগারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে।’
সংস্থাটি আরো জানায়, শহর থেকে সরকারী বাহিনী প্রত্যাহার করার পর, তারা আলেপ্পো বিমানবন্দরও দখল করে এবং ‘কোনও প্রতিরোধ ছাড়াই বেশ কয়েকটি কৌশলগত শহর’ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। অবজারভেটরি জানায়, বিদ্রোহীদের অগ্রগতির মুখে আলেপ্পোর প্রায় ১৪০ কিলোমিটার (৯০ মাইল) দক্ষিণে সিরিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম শহর হামা থেকেও সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের উদ্ধৃত একটি সামরিক সূত্র সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করার বিষয়টি অস্বীকার করে জোর দিয়ে বলেছে, সেনা ইউনিটগুলি এখনও বিদ্রোহীদের আগ্রাসনের মুখে তাদের অবস্থান ধরে রেখেছে।
আলেপ্পোর কেন্দ্রস্থলে একজন এএফপি ফটোগ্রাফার শহরের ল্যান্ডমার্ক দুর্গের বাইরে বিদ্রোহী যোদ্ধাদের দেখেছেন। সেনাবাহিনী নিশ্চিত করেছে যে, বিদ্রোহীরা প্রায় দুই মিলিয়ন লোকের শহরের ‘বড় একটি অংশে’ প্রবেশ করেছে। সেনাবাহিনী বলেছে, বিদ্রোহীদের হামলায় ‘আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর কয়েক ডজন লোক নিহত ও অন্যরা আহত হয়েছে।’ এইচটিএস হল আল-কায়েদার সাবেক সিরিয়া শাখার নেতৃত্বে একটি জিহাদি জোট-যা তাদের মিত্রদের সাথে দীর্ঘদিন ধরে উত্তর-পশ্চিমের ইদলিব অঞ্চলে একটি বিদ্রোহী ছিটমহল নিয়ন্ত্রণ করেছে।
অবজারভেটরির প্রধান রামি আবদেল রহমান এএফপিকে বলেছেন ‘এই মুহূর্তে সিরিয়ার সরকারকে তার প্রধান মিত্র ইরান ও রাশিয়া পরিত্যাগ করেছে বলে মনে হচ্ছে। তবে মস্কো এখন পর্যন্ত প্রতীকী হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।’ অবজারভেটরি জানায়, রাশিয়া রাতে আলেপ্পোর কিছু অংশে বিমান হামলা চালায়। পরে শনিবার নতুন করে হামলায় ‘কমপক্ষে ১৬ বেসামরিক লোক নিহত ও আরও ২০ জন আহত’ হয়েছে। এএফপির একজন ফটোগ্রাফার একটি মিনিবাসসহ পোড়া গাড়ি দেখেছেন। একটি গাড়ির ভিতরে পাশের একটি ছোট হ্যান্ডব্যাগসহ পিছনের সিটে এক মহিলার লাশ পড়ে ছিল।
বিদ্রোহী যোদ্ধারা বাসিন্দাদের নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় সময় রোববার বিকেল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করেছে। ফ্রান্স বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানায়, মস্কো ও তেহরানের উপর আসাদের নির্ভরতা আলেপ্পো হারানোর পথ তৈরি করেছে। মার্কিন ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের মুখপাত্র শন স্যাভেট শনিবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, সিরিয়ার ‘রাশিয়া ও ইরানের উপর নির্ভরশীলতা’ এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক বর্ণিত ২০১৫ সালের শান্তি প্রক্রিয়ার সাথে এগিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে ‘এখন সিরিয়ায় উদ্ভূত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে’।
যোদ্ধাদের একটি থানার বাইরে বিদ্রোহীদের পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। সিরিয়ার সেনাবাহিনী বলেছে, বিদ্রোহীরা ‘আলেপ্পো ও ইদলিব ফ্রন্টে একাধিক অক্ষ থেকে ব্যাপক আক্রমণ’ শুরু করেছে। অবজারভেটরি বলেছে, চতুর্থ দিনের মতো সংঘর্ষ চলাকালে সরকার ১০০ সৈন্য ও সরকার সমর্থক মিলিশিয়ানকে হারিয়েছে আর বিদ্রোহীদের ১৮৩ জন নিহত হয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, বিদ্রোহীরা মারেত আল-নুমান ও খান শেখুনসহ উত্তর জুড়ে কয়েক ডজন শহর দখল করেছে।
বিদ্রোহী যোদ্ধা মোহাম্মাদ হাম্মাদি সিরিয়ার যুদ্ধ-পূর্ব উৎপাদন কেন্দ্র আলেপ্পোর একটি চত্বরে এএফপিকে বলেছেন, ‘আমরা বছরের পর বছর ধরে এটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম।’ ২৯ বছর বয়সী এই যুবক আরো বলেন, ‘আল্লাহর ইচ্ছায় (ইনশাআল্লাহ্) আমরা পুরো সিরিয়া পরিষ্কার করতে যাচ্ছি।’ সরকারপন্থী রেডিও স্টেশন শাম এফএম জানিয়েছে, ‘আলেপ্পোর বেশ কয়েকটি রাস্তায় ও পাড়ায় সশস্ত্র গোষ্ঠী উপস্থিত ছিল।’ এতে আরো বলা হয়, ‘বেশিরভাগ বেসামরিক মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে যাচ্ছে না। তবে শহরের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি প্রায় সম্পূর্ণরূপে বন্ধ।’
অবজারভেটরি বলেছে, ‘আলেপ্পোর গভর্নর, পুলিশ ও নিরাপত্তা শাখার কমান্ডারদের শহরের কেন্দ্র থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।’ কিছু বিদ্রোহী যোদ্ধা শহরের কেন্দ্রে পৌঁছানোর সাথে সাথে বন্দুকের গুলি ছুড়ে বিজয় উদযাপন করে। সেখানে একটি ট্রাফিক লাইটে একটি বিদ্রোহী পতাকা ঝুলতে দেখা গেছে। আলেপ্পোর পশ্চিম অঞ্চলগুলো ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। রাশিয়া শনিবার তাদের মিত্রের ক্ষতির বিষয়ে ‘চরম উদ্বেগ’ প্রকাশ করে ইরানের সাথে যোগ দিয়েছে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সের্গেই ল্যাভরভ ও ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্বাস আরাঘচির মধ্যে একটি কলের রিডআউটে উদ্ধৃতি করে জানায়, ‘সিরীয় আরব প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার জন্য দৃঢ় সমর্থন পুনঃনিশ্চিত করা হয়েছে।’ তেহরান বলেছে, আরাগচি বিদ্রোহী হামলার বিষয়ে আলোচনার জন্য রবিবার দামেস্কে যাবেন। সেখানে আলেপ্পোতে ইরানের কনস্যুলেটেও হামলা হয়েছে।