বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমন্বয়হীনতায় হুমকির মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। ফলে, বিশাল এলাকা জুড়ে অবস্থিত এই ক্যাম্পাসের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ওপর নির্ভর করতে হয়। সেখানেও রয়েছে সমন্বয়হীনতা। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি ভোগান্তিতেও পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত এস্টেট অফিসের সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৩টি স্থানে স্থায়ী ডাস্টবিন রয়েছে। যে জায়গাগুলো থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে নিয়ে যায় সিটি কর্পোরেশন। স্থানগুলো হলো- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার উত্তর নীলক্ষেত, দক্ষিণ নীলক্ষেত, গিয়াসউদ্দিন আবাসিক এলাকা, উত্তর ফুলার রোড, দক্ষিণ ফুলার রোড, ঈশা খাঁ আবাসিক এলাকা, রোকেয়া হল, শিববাড়ি এলাকার সামনে, বঙ্গবন্ধু টাওয়ারের ভিতরে, এস এম হলের ভিতরে, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ভিতরে, সূর্যসেন হলের ক্যাফেটেরিয়ার বিপরীতে এবং শামসুন নাহার হল ও জগন্নাথ হলের কোনায় অবস্থিত ডাস্টবিন। প্রতিদিন রাতে নির্ধারিত স্থানগুলো থেকে সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা বর্জ্য নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় এর ভিন্ন চিত্র।
দেখা যায়, উত্তর নীলক্ষেত, দক্ষিণ নীলক্ষেত এবং বঙ্গবন্ধু টাওয়ার সংলগ্ন ডাস্টবিন থেকে নির্ধারিত সময়ে বর্জ্য নিয়ে যাওয়া হলেও বাকি স্থানগুলো থেকে নির্ধারিত সময়ে বর্জ্য নিয়ে যাওয়া হয়নি। ডাস্টবিনগুলোতে ময়লা উপচে পড়ে আছে এবং এর আশপাশেও অনেক ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে থাকতে এবং দুর্গন্ধ ছড়াতে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবনের প্রবেশ পথের পাশেই রয়েছে অস্থায়ী ডাস্টবিন। এখান থেকেও প্রতিদিন ময়লা নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও তা নিয়ে যাওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পেছনে, টিএসসি সংলগ্ন উদ্যানের গেট এবং মেট্রোরেলের টিএসসি স্টেশনেও প্রচুর ময়লা পড়ে থাকতে দেখা যায়।
নিয়মিত ময়লা নিয়ে না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ অঞ্চল - ১ এর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম বাসসকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ টি বর্জ্য রাখার ডাস্টবিনের কথা বলা হলেও এর বাইরেও নানা স্থানে বর্জ্য রাখার কারণে সব বর্জ্য সঠিক সময়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। সিটি কর্পোরেশন কাজ করে রাতের বেলা কিন্তু এস্টেট অফিসের কর্মীরা কাজ করেন দিনের বেলা। তাই, সমন্বয়হীনতা রয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় একটা বড় এলাকা উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিটি কর্পোরেশনের অধীনে না রেখে আলাদা ব্যবস্থা থাকলেই ভালো হতো বলে তিনি জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মাত্র ৩০ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মী রয়েছে এস্টেট অফিসের অধীনে, যে পরিমাণ লোকবল প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে সুন্দর রাখার জন্য সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই।’ এদিকে শামসুন নাহার হল ও জগন্নাথ হল সংলগ্ন ডাস্টবিন এবং সূর্যসেন হল ক্যাফেটেরিয়া সংলগ্ন ডাস্টবিন এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এ দুটি স্থায়ী ডাস্টবিনে এখন আর কোন ময়লা রাখা হয় না। পরিত্যক্ত অবস্থাতেও শামসুন নাহার হল ও জগন্নাথ হল সংলগ্ন ডাস্টবিনের জায়গায় পাতাসহ ময়লার স্তূপ জমে থাকতে দেখা যায়।
ডাস্টবিনের আশেপাশের রাস্তায় ফাটল এবং ভেঙে গিয়ে ছোট থেকে মাঝারি আকারের গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। যার ঠিক নিচেই রয়েছে সুয়ারেজ লাইন, পানির লাইন এবং উপরে রয়েছে বিদ্যুতের তার। জগন্নাথ হলের একজন নিরাপত্তা প্রহরী বলেন, ‘এখানে জরুরি বিদ্যুতের কাজ করতে প্রায়ই টেকনিশিয়ানরা আসেন। রাস্তার গর্তগুলো ঠিক না করলে যে কোন সময় দূর্ঘটনা ঘটতে পারে।’
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দেখা যায়, ডাস্টবিনগুলো আকারে তা খুবই ছোট এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ময়লা ফেলার বিনের অভাব রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থী অধরা হোসেন বাসস’কে বলেন, ‘মল চত্বর, উদ্যানের ফুটপাত ধরে কার্জন হলে যাওয়ার রাস্তাগুলো নোংরা থাকে। এই জায়গাগুলোয় রিকশাচালক ও পথচারীরা প্রস্রাব করার কারণে এতোটা বাজে গন্ধ থাকে যে হাঁটার মতো অবস্থা থাকে না। অধিকাংশ মানুষ ডাস্টবিন থাকার পরেও তা ব্যবহার করছে না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী আজরা হুমায়রা বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আবর্জনা বিষয়ে ইতিবাচক কিছু বলার নেই। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচ্ছন্ন রাখতে একটি স্বেচ্ছাসেবী দল থাকতে পারে। পাশাপাশি প্রশাসনের নজর দেওয়া জরুরি যেন ক্যাম্পাসের পরিবেশ ক্যাম্পাসের মতোই থাকে। শিক্ষার্থীরাও যেখানে সেখানে ময়লা ফেলছে। এ বিষয়ে আরও সচেতনতা তৈরি করতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো ঘুরে দেখা যায়, হলের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায়ও সামগ্রিকভাবে ঘাটতি রয়েছে। হলগুলোর সামনে ময়লার স্তূপ জমে থাকতে দেখা যায়। শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের শিক্ষার্থী মানজুর হোছাঈন মাহি বলেন, ‘হলের সামনে যে ডাস্টবিন রয়েছে তা আকারে খুবই ছোট। ফলে, ময়লা বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। বৃষ্টি হলে পানি জমে ময়লাগুলো ভাসতে থাকে। ময়লাযুক্ত নোংরা পানির উপর দিয়েই চলাচল করতে হয় শিক্ষার্থীদের। এতে ভোগান্তির শেষ থাকে না।’
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি বাসসকে জানান, ‘সঠিকভাবে পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্যগুলো প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে আমরা বর্জ্য থেকে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন করতে পারি। এবিষয়ে প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব রাখা যেতে পারে। এর মাধ্যমে তিনভাবে উপকৃত হওয়া যাবে। প্রথমত আমাদের এনার্জি ঘাটতি পূরণ হবে, দ্বিতীয়ত বর্জ্য থেকে জৈব সার পেতে পারি এবং যারা এক্ষেত্রে কাজ করবে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও হবে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শুরুর ওপর নজর দেওয়া উচিত বলেও তিনি জানান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (প্রশাসন) সায়েমা হক বিদিশা বাসস’কে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন উৎসবকে ঘিরে ব্যাপক সক্রিয়তা দেখা যায়। উৎসবগুলোতে শিক্ষার্থী ছাড়াও অনেক মানুষের আগমন ঘটে, তখন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটা চ্যালেঞ্জ দেখা যায়। পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের জন্যও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিষয়গুলো চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় জটিলতা দেখা যায়। তবে বিভিন্ন জায়গায় যে ডাস্টবিন রয়েছে তা যেন আরও ভালোভাবে ব্যবহার এবং পরিচ্ছন্নতার কাজ নিয়মিত করা যায় এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হবে। আরও লোকবল নিয়োগ করার চেষ্টা আমাদের রয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কীভাবে আরও আধুনিকীকরণ করা যায় এ বিষয়গুলো নিয়েও প্রশাসন চিন্তা করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।