শরীরে গুলির স্প্রিন্টার নিয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছেন সিজান

Oct 9, 2024 - 18:58
শরীরে গুলির স্প্রিন্টার নিয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছেন সিজান

বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়েও সরকারি চাকুরি পাননি সিজান। সরকারি চাকুরির বয়স চলে গেছে তার। ক্ষোভে-দুঃখে যোগ দিয়েছিলেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। বিক্ষোভ মিছিল করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে  আহত হয়েছেন তিনি। গত দুই মাস ধরে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছেন সিজান। জেলা সদরের দক্ষিণ মুন্সিপাড়া মহল্লার বীর মুক্তিযোদ্ধা তৌহিদুল ইসলাম সানু ও মনোয়ারা বেগম দম্পতির  পুত্র রেজোয়ান ফেরদৌস সিজান (৩৪)। দুই ভাইয়ের মধ্যে সে বড়। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছোট ভাই লাবিব ফেরদৌস আকস্মিক জ্বরে মারা গেছে। এর দুমাস পর এপ্রিল মাসে মারা গেছে বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা তৌহিদুল ইসলাম সানু । অল্প সময়ের ব্যবধানে একই পরিবারের দুই জনের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই নিজের এমন বিপর্যয়ে দিশেহারা সিজান। 

আহত সিজানের সাথে আলাপকালে তিনি বাসসকে বলেন, গত ৪ আগস্ট দুপুরে দিনাজপুর শহরের জেলা স্কুলের সামনে বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের একটি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল সদর হাসপাতাল মোড় হয়ে শহরের লিলি মোড় পর্যন্ত অগ্রসর হয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধার মুখে বিক্ষোভ মিছিলটি ঘুরে আবার জেলা স্কুলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মিছিলটি শহরের মুন্সিপাড়া ভুটি বাবুর মোড়ে পৌঁছালে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ওই বিক্ষোভ মিছিলের ওপর গুলি  ছোঁড়ে। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সিজান দৌড়ে সদর হাসপাতালের দিকে যাওয়ার পথে তার শরীরে বেশ কিছু স্টীল বুলেট ও রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়। সে রক্তাক্ত অবস্থায় সদর হাসপাতালের গেট পার হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সেখানে দীর্ঘক্ষণ মাটিতে  পড়ে থাকার পর, স্বেচ্ছাসেবীরা  তাকে উদ্ধার করে সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। কিন্তু হাসপাতালে রোগীর ভীড় থাকায় চিকিৎসা পেতে দেরি হয়। আমার মা আর আমার স্ত্রীর অনুরোধে অনেকক্ষণ পর একজন ডাক্তার ও ওয়ার্ড বয় আমার কাছে এসে স্যাভলন দিয়ে ক্ষত স্থানগুলো পরিষ্কার করে দেয়। 

সিজান জানান, সেদিন হাসপাতালে ভিড় থাকায় চিকিৎসকরা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সেবা দেওয়ার কথা বলেন। সাথে ব্যথার  ঔষধ লিখে দেন। অন্য কোন পরিবহন না পেয়ে সিজানের মা ও স্ত্রী একটি ভ্যানে করে তাকে বাসায় নিয়ে যান। রাতে সারা শরীর ফুলে ব্যথার যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন। সারারাত সিজান ও তার পরিবারের মানুষ দুর্বিষহ নির্ঘুম রাত কাটায়। পরদিন ৫ আগস্ট সকালে আবার ভ্যান যোগে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই হাসপাতালে চিকিৎসক দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে। দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরুরি বিভাগে যাওয়ার পর বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা শেষে ভর্তি করে নেওয়া হয়। সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে কোন বেড খালি না থাকায় হাসপাতালের মেঝে পর্যন্ত সারিবদ্ধ ভাবে গুলিবিদ্ধ আহত রোগীদের শুয়ে রাখা হয়েছিল। সেখানেই জায়গা হয় সিজানের। 

তিনি বলেন, অনেক অপেক্ষা ও খোঁজাখুজির পর একজন  চিকিৎসক এসে আমার ক্ষতস্থান পরীক্ষা করে দেখে। আমার শরীরে ৪টি এক্সরে  ও এমআরআই করার জন্য পরামর্শ লিখে দেন। হাসপাতালে ভিড় থাকায় স্থানীয় পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার ফুলবাড়ী বাসস্ট্যান্ডে এসে সন্ধ্যার পর এক্সরে এবং  এমআরআই পরীক্ষা করাই। সেদিন রাতেই রিপোর্ট নিয়ে পরদিন ৬ আগস্ট দুপুরে হাসপাতালের সার্জিক্যাল বিভাগের বিশেষজ্ঞ  চিকিৎসক আমার এক্সরে এবং এম আরআই রিপোর্ট দেখেন। তিনি বলেন, শরীরে ৭টি গুলি রয়েছে।  জরুরি ভাবে ওই দিন বিকেলে আমার শরীরে অস্ত্রোপচার করে ডান হাত ও বাম পা থেকে দু’টি গুলি বের করা  হয়। দু’দিন পর ৮ আগস্ট শরীরে  আবারো অস্ত্রোপচার করা হবে বলে আমাকে জানান। 

গত ৮ আগস্ট  আবার একইভাবে শরীরের ক্ষত স্থানগুলোতে অস্ত্রোপচার করা হয়। এদিন চিকিৎসক আরো ৪ টি গুলি বের করতে সক্ষম হন। কিন্তু একটি গুলি ডান হাতের কব্জির মধ্যে এমন স্থানে আটকে ছিল যা বের করা সম্ভব হয়নি। চিকিৎসক বলেছেন, ওই গুলিটি অপারেশনের মাধ্যমে বের করতে সময় লাগবে। হাসপাতালে ওষুধ ও স্যালাইন দিয়ে কয়েক দিন রাখা হয়। এরপর গত ২৭ সেপ্টেম্বর সিজানের শরীরে আবারো ৪টি এক্সরে করে ক্ষতগুলোতে কোন গুলির স্প্রিন্টার আছে কিনা পরীক্ষা করা হয়। মাথার ডান পাশে কানের উপরে গুলির স্প্রিন্টার রয়েছে বলে চিকিৎসক জানান। আপাতত চিকিৎসা নিয়ে বাসায় থাকতে বলেন তিনি।

এক মাস পর আবারো এক্সরে এবং এমআরআই করে রিপোর্ট দেখে এখানে সম্ভব হলে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ডান হাতের কব্জিতে থাকা গুলি বের করার কথা জানালেন চিকিৎসক।  নিজের দুর্ভাগ্য-দুর্দশায় হতবিহ্বল সিজান বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে এখন আপাতত, নিজেদের বাসায় অসহ্য যন্ত্রণায় দিনাতিপাত করছি। রাতে ঠিকমত ঘুমাতে পারি না। মাঝে মধ্যেই অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকি।  সিজান দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলেন, আমি চাকুরির জন্য আবেদন করে তৎকালীন দিনাজপুর সদর আসনের সংসদ সদস্য সাবেক হুইপ ইকবালুর রহিম এর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছেন ‘তুমি ছাত্রদলের রাজনীতি করো, তোমার কোন চাকুরি হবে না। ছাত্রদল বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আসো, তোমাকে চাকুরি দিব’। তারপর থেকে আমি অনেক জায়গায় চাকরির আবেদন করে কোন চাকুরি পাইনি। 

সিজান দিনাজপুর জেলা স্কুলের মেধাবী ছাত্র। তিনি গত ২০০৫ সালে এসএসসি এবং গত ২০০৭ সালে দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা এআইবি কলেজে থেকে কৃতিত্বের সাথে বিবিএ পাস করেন। তারপর একাধিক জায়গায় বাবার মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকুরির আবেদন করেন। কিন্তু তার কোন চাকুরি হয়নি। এখন তার চাকুরির বয়স শেষ হয়ে গেছে। 

এদিকে বাবা মারা যাওয়ার পর সিজানের মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সংসারের কাজকর্ম ঠিকমতো করতে পারেন না। সিজান ও তার বৃদ্ধ মা ছাড়া তার পরিবারে আর কেউ নেই। এ অবস্থায় এ বছরের ১৪ মে সিজান তার বাড়ির পাশেই মুন্সিপাড়া মহল্লার সাজিদ ইসলামের কন্যা শারমিন আক্তারকে বিয়ে করেন। পরিবারে মা, স্ত্রী ও তিনি নিজেসহ তিন সদস্য রয়েছেন। সিজান সরকারী চাকরি না পেয়ে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করছিলেন। ওই চাকুরি থেকে তিনি যে বেতন পেতেন এবং মরহুম বাবার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দিয়ে কোন রকমে সংসার চলে আসছিল। এর মধ্যে দুর্ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে সে কর্মহীন হয়ে পড়ায় এক দিকে তার চিকিৎসার ব্যয়, অন্যদিকে সংসারের ব্যয়ভার বহন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন। শারীরিক ও মানসিক কষ্টের সাথে যুক্ত হয়েছে আর্থিক টানাপোড়েন। সব মিলিয়ে একটা মানবেতর জীবন যাপন করছেন সিজানের পরিবার। 

সিজানের মা মনোয়ারা বেগম (৬০) বলেন, ‘আমার দুই পুত্র সন্তান ছিল। সিজান আমার প্রথম পুত্র এবং লাবিব ফেরদৌস দ্বিতীয়। ২০২৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি লাবিব হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তার দুই মাস পর ৪ এপ্রিল আমার স্বামী  বীর মুক্তিযোদ্ধা তৌহিদুল ইসলাম সানু মারা যায়। একই বছর আমার পরিবারে দু'টি মৃত্যু শোক আমি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এর মধ্য একমাত্র সন্তান সিজানের শরীরের এই অবস্থা। তার চিকিৎসার ব্যয় বহন করার ক্ষমতা আমাদের নেই। খুবই অসহায় লাগছে। 

তিনি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের কাছে সন্তানের সুচিকিৎসা ও তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। সিজানের স্ত্রী শারমিন আক্তার বলেন, আমার স্বামী আহত হওয়ার পর দীর্ঘ সময় হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। কেউ তার খোঁজ নেয়নি । এখন পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক দল বা সরকারের পক্ষ থেকে কোন ধরনের সাহায্য সহযোগিতা পাননি বলেও তিনি আক্ষেপ করেন।  যারা তার স্বামীর ওপর গুলি চালিয়ে তাকে আহত করেছে তিনি অন্তবর্তী কালীন সরকারের কাছে তাদের বিচারসহ তার স্বামীর সুচিকিৎসার দাবি জানান।