শেখ হাসিনার শোষণতন্ত্র বনাম একনায়কতন্ত্র

Jul 30, 2024 - 21:56
শেখ হাসিনার শোষণতন্ত্র বনাম একনায়কতন্ত্র

শিহরন

শেখ হাসিনা অনেকটা একনায়কতন্ত্রের আদলে বাংলাদেশ চালাচ্ছেন। সংবিধান অনুযায়ী তিনি প্রধানমন্ত্রী হলেও বাস্তবে তিনি ‘ডিক্টেটর’ এর ভুমিকা পালন করছেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার ও সংসদীয় রীতি-নীতি পদদলিত করেছেন। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে তিনি ধীরে ধীরে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যেকটি অংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছেন। বিশেষ করে পুলিশ বাহিনী ও র‌্যাবকে একরকম দলীয় ভৃত্য বানিয়ে রেখেছেন। 

আর এই উর্দিপরা ভৃত্যরা ন্যায়ের পথে চলা ও সত্য বলা মানুষের মুখে কুলুপ এঁেট দিয়েছে। অস্ত্রের মুখে বিরোধী পক্ষ এবং সংবাদপত্র ও টিভি মিডিয়াগুলোর কণ্ঠরোধ করেছে। শেখ হাসিনা এমন একটি পরিস্থিতি তৈরী করেছেন যে- ‘তিনি যা বলবেন ও করবেন তাই সঠিক, তা কখনো ভুল হতে পারেনা। তার কথা ও কাজের বিরুদ্ধে কথা বলার মত সাহস কারও নেই।’ মন্ত্রী থেকে শুরু করে এমপি, রাজনৈতিক নেতা, বিচারপতি, আমলা, সেনাকর্তা, পুলিশের বড়কর্তা, সাংবাদিক, এনজিও কর্তা, ব্যবসায়ী নেতা, শিল্পপতি কেউই তার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারেনা-সত্য ও ন্যায়ের কথা তুলে ধরার বিষয়টিতো দূরে থাক।

দলগত একনায়কতন্ত্রের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনব্যবস্থার সঙ্গে তা সিংহভাগ মিলে যায়। বরং কিছু কিছু আচরণ ও কর্মকান্ড ইতিহাসের ঘৃণ্য নাৎসীবাদী ও ফ্যাসিস্ট দলকেও ছাড়িয়ে যায়। রাষ্ট্রক্ষমতা পুরোপুরি একটি দলের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকলে তাকে দলগত একনায়কতন্ত্র বলে। এক্ষেত্রে ব্যক্তি বা দলনেতার সার্বিক প্রাধান্য থাকে। তাই কার্যক্ষেত্রে দলগত একনায়কতন্ত্রও ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা ব্যক্তিগত একনায়কতন্ত্রে পরিণত হয়। 

এই ধরনের একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকেনা। ব্যক্তি জীবনের সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়। বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করতে গিয়ে ন্যায়-অন্যায় সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়। মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে বিচারের প্রহসনের মাধ্যমে বিরোধী নেতাদের কারারুদ্ধ, মৃত্যুদন্ড এমনকি গুপ্তহত্যার মাধ্যমে দেশের জনগণের মাঝে ভীতি সঞ্চার করা হয়। দলগত একনায়কতন্ত্রে আইন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকেনা। একনায়কের জনকল্যাণকর, উন্নয়ন ও গৌরবময় নেতৃত্বের কথা সর্বদা প্রচার করা হয়। মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা হয়। ঐ রাষ্ট্রে ব্যাপক গুপ্তচর ব্যবস্থা থাকে। শাসন ব্যবস্থায় সকল ক্ষেত্রে যথেষ্ট গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়।

শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ২০০৯ সাল থেকেই প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ওপর অত্যাচার-নির্যাতন ও দমন-পীড়ন চলতে থাকে। রাজধানী ঢাকার প্রত্যেকটি থানায় তালিকা করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়। স্বজনদের ওপর চালানো হয় বুলডোজার। এমনকি সারাদেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে বেছে বেছে বিএনপি-জামায়াত নিধন চলে। 

শেখ হাসিনার আজ্ঞাবহ উর্দিপরা ভৃত্য এবং গুপ্তবাহিনী মিলে এরপর শুরু করে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড ও গুম। এতে নেতা-কর্মী ছাড়াও, সাংবাদিক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। ২০১০ সালের ২৪ জুন গুলিস্তান এলাকার প্রভাবশালী ওয়ার্ড কাউন্সিলর বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম নিখোঁজ হন। পরিত্যক্ত গাড়িটি উদ্ধার হলেও তাঁকে আর পাওয়া যায়নি। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল মহাখালী এলাকা থেকে গাড়িচালক আনসার সহ নিখোঁজ হন বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী এমপি। গত ১১ বছরেও তাঁদের হদিস মেলেনি। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমদ ২০১৫ সালের ১০ মার্চ রাজধানীর উত্তরা থেকে নিখোঁজ হন। এর ৬৩ দিন পর ১১ মে তাঁকে ভারতের মেঘালয়ের শিলংয়ে স্থানীয় পুলিশ মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে ভারতের আদালতে সালাহউদ্দিন বলেন, তাঁকে উত্তরার বাসা থেকে আইন-শৃংখলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ করা হয়েছিল। এর প্রায় দুই মাস পর তারা তাঁকে শিলংয়ে ফেলে যায়। অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে তিনি প্রায় ৮ বছর ধরে সেখানে অবস্থান করছেন। 
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমের পুত্র সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আল আযমী ও জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর পুত্র ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাসেম আরমান ২০১৬ সালের আগষ্ট মাস থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। তাদেরকে নিজ নিজ বাসা থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে আটক করা হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের পরিবার-পরিজন জানতে পারেনি তারা কোথায় কী অবস্থায় আছেন।

হংকং ভিত্তিক এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এপর্যন্ত বাংলাদেশে ৬১৯ জন নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটকের পর গুম হয়েছেন। এই সময়ে কমপক্ষে ২৬৫৮ জন মানুষকে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়। মানবাধিকার বিষয়ে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৬১৩ জন গুমের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ৭৯ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনী গ্রেফতার দেখিয়েছেন ৮৯ জনকে, ফেরত এসেছেন ৫৭ জন, বাকিদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
শেখ হাসিনার শোষণতন্ত্রে রোষের শিকার হয়েছেন সাবেক তিন বারের (সর্বজনগৃহীত দুই বার) প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে দুর্নীতির একটি সাজানো মামলায় ২০১৭ সালে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত তাঁকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেন। একই বছরের ৩০ অক্টোবর এই মামলায় খালেদা জিয়ার আপিল খারিজ করে হাইকোর্ট বিভাগ সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেন। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর ঢাকার আরেকটি বিশেষ জজ আদালত তাঁকে ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন। 

কিন্তু দেশের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এসব মামলা হওয়া থেকে শুরু করে মামলা তদন্ত এবং সকল কোর্টের রায়ই সরকার দ্বারা প্রভাবিত ছিল। বেগম জিয়া এখনও কার্যত বন্দী আছেন। করোনা মহামারী শুরুর পর জনদাবি এবং পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তাঁকে দু’টি শর্তে সাময়িক মুক্তি দেয় সরকার। প্রথমত, বেগম খালেদা জিয়াকে নিজ বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, তিনি বিদেশ যেতে পারবেন না। এরপর থেকে তিনি সরকারের নজরবন্দী আছেন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর ঐ রাতেই তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে বিএনপি। এখনও সেটি বহাল আছে। তারেক রহমান ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত সরকারের আমলে গ্রেফতার হন। পরের বছর চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি পেয়ে যুক্তরাজ্যে যান। এখনও সেখানে অবস্থান করেই দলকে নানা নির্দেশনা দিচ্ছেন। শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় তারেক রহমান সম্পর্কে নানা আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়ে তাঁর প্রতি গভীর রোষের বিষয়টি দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এটা আরও স্পষ্ট হয়েছে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় তারেক রহমানের নাম অন্তর্ভুক্ত করে সম্পূরক চার্জশীট দেবার পর। এই মামলায় তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। 

অথচ সেনাসমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সিআইডির এসপি ফজলুল কবীর ২০০৮ সালের ১১ জুন ২২ জনকে অভিযুক্ত করে যে অভিযোগপত্র দাখিল করেন সেখানে তারেক রহমানের নাম ছিলনা। এমনকি বিচারপতি জয়নুল আবেদীন কমিশন ঘটনার তদন্ত করে যে ১৬২ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছিল তাতেও এই হামলার সঙ্গে তারেক রহমানের সম্পৃক্ততার প্রতি কোন ইঙ্গিত ছিলনা। ঐ রিপোর্টে ভয়াবহ এই হামলার পেছনে একটি শক্তিশালী বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত থাকার কথা বলা হয়। 
সরকারের প্রতিহিংসায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থপাচার মামলায় ৭ বছরের জেল ও ২০ কোটি টাকা জরিমানা, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের জেল ও ২ কোটি ১০ লাখ টাকা জরিমানা এবং বঙ্গবন্ধুকে কটুক্তির মামলায় ২ বছরের দণ্ড দেয়া হয়। কিন্তু তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করায় কোন দণ্ডই সরকার কার্যকর করতে পারেনি।

২০১১ সালে বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মৃত্যুর পর আশির দশকের শিক্ষক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে বিএনপির জাতীয় সম্মেলনে তিনি পূর্ণাঙ্গ মহাসচিবের দায়িত্ব পান। তিনি মহাসচিবের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে গত এক যুগে শেখ হাসিনা সরকার তাঁর বিরুদ্ধে ৯২টি মামলা করেছে। জেলে নিয়েছে অন্তত পাঁচবার। তিনি জেল খেটেছেন সব মিলিয়ে ৩৫০ দিন।  মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্পর্কে দেশের বিশিষ্টজনদের মন্তব্য, রাজনীতির বাইরেও তিনি অত্যন্ত ভদ্রলোক ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে ময়লার গাড়ি পোড়ানো, মোটরসাইকেলের পেছনে বসে সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকে বিষ্ফোরক নিক্ষেপ, পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল ছোঁড়া-এইসব মামলা দেয়া প্রতিহিংসামূলক এবং সত্যিই অমানবিক। 

শুধুই যে বড় নেতারা এই ধরনের রোষানলের শিকার তা নয়, বিএনপির সকল পর্যায়ের নেতা-কমীরাই বানোয়াট সাজানো মামলায় হয় জেল খাটছে নয়তো পালিয়ে বেড়াচ্ছে। দলটির তথ্য মতে, ২০০৯ সাল থেকে এই পর্যন্ত সারাদেশে তাদের নেতা-কর্মীদের নামে দেড় লক্ষাধিক মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামী ৩৬ লাখ। এখনও কারাগারে আটক আছে ২০ হাজার। বিগত নির্বাচনের বছরখানেক আগে এই সংখ্যা আরও পাঁচগুণ বেশি ছিল। 
জোটের শরিক বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর। তাদের নাম নিশানাই একরকম মুছে ফেলা হয়েছে। নিজেদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন বহু নেতা। তাঁদের পরিবার-পরিজনরা ‘রাজাকার তকমা’ নিয়ে দুর্বিষহ দিনযাপন করছেন। 

সরকারের আক্রমণ থেকে বাদ পড়েনি আলেম ওলামারাও। দেশের বিশিষ্ট ৪৮২ আলেম ওলামাকে দীর্ঘদিন যাবত জেল খাটানো হচ্ছে শুধু সরকারেরর সমালোচনা করার জন্য। এমনকি তাঁদের ডান্ডাবেড়ি পড়িয়ে মধ্যযুগীয় নির্যাতনের কায়দায় কোর্টে হাজির করা হচ্ছে। ইসলামী চিন্তাবিদ ও র্ধর্মীয় বক্তা ড. মিজানুর রহমান আজহারী এই সরকারের রোষানলে পড়ে দেশ ছেড়ে মালয়েশিয়া পাড়ি জমাতে বাধ্য হন। সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোঃ আবদুল্লাহ তাঁকে ‘জামায়াতের প্রোডাক্ট’ বলে অভিহিত করেছিলেন। 

শেখ হাসিনা, তার উর্দিবাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ভয়ে দেশের অধিকাংশ মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনরা এখন বয়ানের সময় ধর্মীয় প্রচারের সঙ্গে সরকারি দল ও প্রধানমন্ত্রীর গুণকীর্তন করছেন। তবে আড়ালে এসেই তুলে ধরছেন নিজেদের অসহায়ত্বের কথা। সকল মসজিদ ও মাদ্রাসার কমিটিই আওয়ামী লীগের তথাকথিত নেতা-র্কর্মীদের দখলে চলে গেছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা তাঁর লেখা ‘এ ব্রোকেন ড্রিম’ বইটিতে বাংলাদেশে গণতন্ত্র, আইন ও বিচার ব্যবস্থা এবং বিচার বিভাগের ওপর শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নগ্ন হস্তক্ষেপের নিখুঁত চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। কিছু অপ্রিয় সত্য কথা বলায় এবং সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে শেখ হাসিনা ও তার সরকার ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর এই প্রধান বিচারপতিকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন। পরে বিদেশে গিয়ে তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। 

দেশ ছাড়ার সময় তিনি বলেছিলেন, ‘দেশের প্রধান বিচারপতি যখন বিচার পায়না, তখন সাধারণ মানুষ কিভাবে বিচার পায়।’ পরবর্তীতে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের মামলায় তাঁর ১১ বছরের সাজা হয়। আর্থিক কেলেংকারিতে বাংলাদেশে কোন প্রধান বিচারপতির সাজা হওয়ার ঘটনা এই প্রথম। বিশ্বের কোন দেশে এমন ঘটনার নজির নেই। 
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত ‘আ ব্রোকেন ড্রিম: রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ আত্মজীবনীমূলক ওই বইয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি দাবি করেন, তিনি দেশ ছেড়েছেন ‘হুমকির মুখে’; একই কারণে বিদেশ থেকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। ৬১০ পৃষ্ঠা বইটির ভূমিকায় বিচারপতি সিনহা লিখেছেন, ১৯৭৪ সাল থেকে বাংলাদেশের বিচারাঙ্গনে যুক্ত থাকার সুবাদে এর রূপান্তর এবং বাঁধাগ্রস্ত হওয়ার ঘটনাগুলো দেখার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি আশা করেছিলাম...সরকার হয়ত ওই রায়ের মর্ম বুঝতে পারবে, তারা বুঝবে যে বিচারবিভাগের স্বাধীনতা রাষ্ট্র ও দেশের জন্যই দরকার।’

যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে যে প্রহসন বাংলাদেশে হয়েছে বিচার বিভাগের ইতিহাসে তা নির্লজ্জতার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সাজানো মামলায় মিথ্যা সাক্ষী উপস্থাপন করে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় ৫ নেতা, আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারী জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারি সেক্রেটারী জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলী এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে তাঁদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। একই বিচারে জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়। আপীলের শুনানি চলার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াতে ইসলামীর আমীর ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত গোলাম আযমের মৃত্যু হয়। 

রাজনৈতিক  বোদ্ধাদের মতে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, দীর্ঘদিন অবৈধপন্থায় ক্ষমতায় থাকা এবং দলীয় একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুটি নতুন করে চাঙ্গা করেন। অথচ যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যেসব জামায়াত নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে তাঁদের সঙ্গে এক টেবিলে বসেই তিনি ’৯৫ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পরিকল্পনা করেন, একসঙ্গে আন্দোলন করেন। পরবর্তীতে ক্ষমতায় এসেও তিনি তাঁদের সঙ্গে চলেছেন, কখনও একবারের জন্যও তাঁদের যুদ্ধাপরাধী বলেননি।

বিচার বিভাগের ওপর সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপের কারণে বাংলাদেশে বস্তুত আইনের শাসন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। আজ্ঞাবহ অযোগ্য ব্যক্তিদের বিচারকের আসনে বসানো হয়েছে। ফলে বিচার বিভাগ দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। সাধারণ জনগণ ন্যায়বিচার পাচ্ছেনা। দলীয় প্রভাব ও টাকা থাকলে ভয়ংকর অপরাধীরাও পার পেয়ে যাচেছ। দেশে এখন এমন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে যে, যত আইন-কানুন ও বিচার-আচার যেন শুধু বিরোধীপক্ষ এবং গরীবের জন্য। সরকারদলীয় অপরাধী, টাকাওয়ালা ও দুর্নীতিবাজদের জন্য বিচার বিভাগ আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শেখ হাসিনার শোষণতন্ত্রে দুর্বহ কিন্তু নীরব আঘাত এসেছে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমগুলোর ওপর। অনেকটা নাকের ডগায় বন্দুকের নল রেখে সাংবাদিকদের বলা হয়েছে ‘আপনারা স্বাধীনভাবে লিখুন। লিখলে মরতেও পারেন। তাই বলে, আমরাতো আপনাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করিনি।’ সাংবাদিকদের অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে, হাত-পা বেঁধে হিংস্র কুমিরভর্তি একটি পুকুরে সাঁতরাতে বলা হচ্ছে। বাংলাদেশের সাংবাদিক ও গণমাধ্যমগুলোর পেছনে সেনা পরিচালিত একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থাকে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। যাদের চোখ রাঙানি মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য সবচেয়ে বড় অন্তরায়। সরকারবিরোধী কোন খবর প্রকাশিত হলেই সাদা পোশাকধারীরা গিয়ে ঐ সাংবাদিক অথবা সম্পাদককে আটক করছে, বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নানারকম ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।

শেখ হাসিনা টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রগুলোর মালিকানায় নিজেদের তল্পিবাহক বসিয়ে গণমাধ্যমের এক চোখ অন্ধ করেছেন। দ্বিতীয় চোখ অন্ধ করেছেন ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন প্রয়োগ করে এবং হত্যা, গুম ও জেল এর অস্পৃশ্য আতংক তৈরী করে। তাঁর সরকার ক্ষমতায় এসে দেশে বিরোধী মালিকানার ৩টি টিভি চ্যানেল (চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টিভি) বন্ধ করে দিয়ে ২৭টি নতুন টিভি চ্যানেলের অনুমোদন দেন। যার মালিকানায় সকলেই চিহ্নিত আওয়ামী ঘরানার ব্যবসায়ী। 
প্রিন্ট মিডিয়ার ক্ষেত্রে বিরোধী পক্ষের বহুল প্রচারিত দৈনিক আমার দেশ, দৈনিক দিনকাল ও দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা প্রকাশের অনুমোদন এবং মিডিয়া তালিকাভুক্তি বাতিল করে দিয়ে আওয়ামী মতাদর্শের বাইরে পত্রিকার অনুমোদন একরকম বন্ধ করে দেয়া হয়। গত এক যুগে যারা পত্রিকার ডিক্লারেশন ও মিডিয়া তালিকাভুক্তি পেয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে তিনটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে রাজনৈতিক মতাদর্শ ও ব্যাকগ্রাউন্ড চুলচেরা যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। 
সরকারের তল্পিবাহক এই টিভি মিডিয়া ও সংবাদপত্রগুলোর মালিকেরা নৈতিক মূল্যবোধের জলাঞ্জলি দিয়ে সর্বক্ষণ শেখ হাসিনা, তাঁর সরকার, তাঁর দল ও অঙ্গসংগঠন এবং তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গুণকীর্তন করতে থাকে। শেখ হাসিনার উন্নয়ন আর জনকল্যাণকর কাজ এবং মন্ত্রীদের সভা সেমিনারের খবর ফলাও করে প্রচার করাই যেন এদের মূল দায়িত্ব। আর সরকারি টিভি বিটিভিতো সেই পুরনো ‘বাপ-বেটির বাক্স’ নামের নামকরণের সার্থকতা প্রমাণেই ব্যস্ত রয়েছে। 

শেখ হাসিনা সরকার ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের ‘ষোলকলা’ পূর্ণ করেন। এই আইনের ফলে সাংবাদিকদের স্বাধীনতার কবর রচিত হয়। শেকল বেঁধে দেয়া হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাধারণ জনগণের স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন আর্টিক্যাল নাইনটিন এর তথ্যমতে, আইন  পাস হওয়ার পর ঐ বছরই বাকি তিন মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৩৪টি মামলা হয়। পরের বছর ২০১৯ সালে মামলা হয় ৬৩টি। ২০২০ সালে ১৯৭টি, ২০২১ সালে ২৩৮টি এবং ২০২২ সালে ১২২টি মামলা হয়। 
আর্টিক্যাল নাইনটিন বলেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এপর্যন্ত যতগুলো মামলা হয়েছে এর অধিকাংশই প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের নামে কটুক্তির কারণে। ফেইসবুুক বা অনলাইনে মতপ্রকাশের জের ধরে। বেশিরভাগ মামলার বাদি পুলিশ, র‌্যাব ও সরকারি দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। এসব মামলায় শতাধিক সাংবাদিককে জেল খাটতে হয়েছে। 

শুধু জেল নয়, সাংবাদিকরা সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের দ্বারা হামলা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) মনিটরিং সেলের তথ্যমতে, ২০২২ সালে এক বছরেই ৪ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। অপমৃত্যুর শিকার হয়েছেন আরও ৫ সাংবাদিক। কমপক্ষে ১৬০ সাংবাদিক সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের দ্বারা হামলার শিকার হয়ে দৈহিকভাবে আক্রান্ত ও নির্যাতিত হয়েছেন।
শেখ হাসিনার শাসনামলে পর্দার আড়ালেই বেশিরভাগ কাজ হচ্ছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বত্র গভীর গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে। সাধারণ জনগণকে রাখা হচ্ছে একরকম ধোঁয়াশার মধ্যে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সাংবাদিক দেখলেই কেমন যেন ইতস্তত বোধ করেন। তাঁদের নাকি সাংবাদিকদের কোন তথ্য না দেয়ার ব্যাপারে অলিখিত কঠিন নির্দেশনা দেয়া আছে। আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোর ব্যাপারেও পররাষ্ট্র দফতর খোলাসা করে কিছু বলছেনা। 

শেখ হাসিনা নিজেই একটি প্রেস কনফারেন্সে বলেছেন, ‘আমি ভারতকে যা দিয়েছি তা তাঁরা সারাজীবন মনে রাখবে।’ কিন্তু তিনি ভারতকে এই পর্যন্ত কি কি দিয়েছেন সেই ব্যাপারে কিছু বলেননি। সাধারণ মানুষ এ সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেনা। সরকারও সাংবাদিকদের কাছে পরিষ্কার কোন বিবৃতি দেয়নি। 
সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গোপন কারাগারে আটক থাকার ৪৬৭ দিন পর ফিরে আসেন। কিন্তু সরকার এই দীর্ঘ সময় একটি কথাই বলেছে, তাঁরা কিছুই জানেনা। তিনি ফিরে আসার পর জানা যায়, আইন-শৃংখলা বাহিনী রাস্তা থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে এতদিন আটকে রেখেছিল। কোন বাহিনী তাঁকে আটকে রেখেছিল তিনি বলতে পারেননি। সরকারও সেই বিষয়টি গোপন রেখেছে। 

২০২০ সালের ১১ মার্চ পুরনো ঢাকার চকবাজার এলাকায় বাসা বের হয়ে নিখোঁজ হন ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল। নিখোঁজ হওয়ার ৫৩ দিন পর গভীর রাতে যশোর বেনাপোল সীমান্তের একটি মাঠ থেকে তাঁকে উদ্ধার করার কথা বলা হয় বিজিবির পক্ষ থেকে। তাঁর নামে ভারত থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের মামলা দেয়া হয়। আদালতে উপস্থিত মিডিয়ার সহকর্মীদের কাজল বলেন, ‘গুম হয়ে যাওয়া যে কত কষ্টের, কত দুর্বিষহ, কত বেদনার তা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না।’  পরিবেশবাদী আন্দোলনকারী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিককে অপহরণের ৩৫ ঘন্টা পর নাটকীয়ভাবে উদ্ধার করে পুলিশ। কে বা কারা তাঁকে অপহরণ করেছিল সেই বিষয়টি সরকার চেপে যায়। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বা স্বামীও এ ব্যাপারে আর মুখ খোলেননি। এরকম গুম ও অপহরণের অসংখ্য ঘটনা রয়েছে যা সরকারের তদারকিতে ঘটছে, কিন্তু সরকার স্বীকার করছেনা। 

শেখ হাসিনা সরকারের মাঝে ব্যাপক গুপ্তচর ব্যবস্থা রয়েছে। যারা একের পর এক এইসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও একজন সিনিয়র সচিবের কাছে গল্প করেছেন যে, সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বাইরেও তাঁর ব্যক্তিগত গুপ্তচর বাহিনী রয়েছে। এই গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমে জনগণের সাংবিধানিক ব্যক্তি অধিকার হরণ করা হচ্ছে। কোন ব্যক্তির অনুমতি ছাড়াই তাঁর ফোনে আড়িপাতা হচ্ছে। রেকর্ড করা হচ্ছে কল। পরে সুযোগ বুঝে সেটা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হচ্ছে অথবা তাঁকে ব্ল্যামেইলিং করা হচ্ছে। 

২০১৩ সালে নির্বাচনের আগে সমঝোতার বৈঠক বিষয়ে তৎকালীন বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া ফোন কল ফাঁস হয়। এরপর নিয়মিত বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দর টেলিফোন আলাপ ফাঁস হবার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে তত্ত্বাবধয়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের সঙ্গে সাংবাদিক আব্দুর রব মজুমদারের কথোপকথন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও শমসের মবিন চৌধুরি, সাদেক হোসেন খোকা ও মাহমুদুর রহমান মান্না, মাহি বি চৌধুরি ও মাহমুদুর রহমান মান্না, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর কল রেকর্ড অন্যতম। 

বাংলাদেশের একজন চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির সঙ্গে সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের কুরুচিপূর্ণ কথোপকথন কল রেকর্ড ফাঁস হওয়ায় তাঁর মন্ত্রিত্ব চলে যায়। দুই বছর পর ঐ কল রেকর্ডটি সামাজিক মাধ্যমে ফাঁস করা হয়। 
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল (চাকরিকালীন সময়ে শেখ হাসিনার অত্যন্ত অনুগত ভৃত্য) চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী অবসরে গিয়ে বিদেশে অবস্থানরত এক সাংবাদিকের সঙ্গে টক শো’তে সরকারের বেশ কিছু গোমর ফাঁস করে দেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ‘মানুষের কথা বলার অধিকার নেই। দেশে কোনও গণতন্ত্রও নেই, জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করার অধিকারই হারিয়ে ফেলেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে না। যার ফলে সরকারকে পুলিশ, মিলিটারি আর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জোরে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হচ্ছে।’ 

তিনি শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের ‘বিশেষ সম্পর্ক’ এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বর্তমান অবস্থান নিয়েও তীব্র সমালোচনা করেন। সারওয়ার্দীর এইসব বক্তব্যের কিছুদিনের মধ্যেই তার স্ত্রী মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ফারজানা ব্রাউনিয়ার বিভিন্ন গোপন ও আপত্তিকর কল রেকর্ড সামাজিক মাধ্যমে ফাঁস হতে শুরু করে। সাবেক ঐ সেনাকর্তাও আকস্মিক চুপসে যায়। 

শেখ হাসিনার শাসনব্যবস্থায় দলীয় একনায়কতন্ত্রের সবচেয়ে বড় যে বৈশিষ্ট্যটি নজরে পড়ে তা হলো, জনগণের মতামতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করা। তাঁদের মত প্রকাশ এবং ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া। এই শাসনামলের ১৫ বছর হতে চলেছে, কিন্তু সাধারণ জনগণ এই দীর্ঘসময়ে একবারও ভোট দিতে পারেনি। শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের আচরণ অনুযায়ী জনগণ বলতে দেশের আপামর জনগোষ্ঠী নয় শুধু আওয়ীমী লীগ ও তাঁদের সমর্থকদেরই মনে করা হচ্ছে। 
বিগত দু’টি নির্বাচনেই শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার সুকৌশলে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে সাধারণ মানুষ এবং বিরোধীপক্ষের নাগরিকদের ভোট দেয়া থেকে বিরত রেখেছেন। ভোটের আগের রাতে নির্বাচন কর্মকর্তা, পুলিশ ও দলীয় নেতা-কর্মীদের দিয়ে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রেখেছেন। ভোটের দিন অনেকে ভোট না দিয়েই কেন্দ্র থেকে ফিরে এসেছে। 
এর আগের নির্বাচনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক চাপে বিরোধীদের সঙ্গে ‘আইওয়াশ’ আলোচনায় শেখ হাসিনা নির্বাচন আয়োজনে এমন কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছেন এবং একইসঙ্গে মাঠে আন্দোলনকারীদের জুলুম নির্যাতন করে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরী করেছেন যাতে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি ও তার শরিকরা নির্বাচনে না আসে। হয়েছেও তাই। বিরোধীদল বিহীন ঐ নির্বাচনে শুধু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই একচেটিয়া ভোট দিয়েছে। সাধারণ মানুষ এবং বিরোধীপক্ষ ঘরে বসেই ‘নির্বাচনী তামাশা’ দেখেছে।

শেখ হাসিনা সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের আড়াই বছরের মাথায় ২০১১ সালের জুনে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাশ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলোপ করে। অথচ তাঁরাই একসময় নির্বাচনে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির দাবিতে মাসের পর মাস অসহযোগ আন্দোলন, হরতাল, অবরোধ করেছিল। বহুল প্রত্যাশিত এই পদ্ধতিতে নির্বাচন করে ক্ষমতায় এসে যখন তাঁরাই আবার এই পদ্ধতি বাতিল করে তখন তাঁদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। শাসনব্যবস্থায় ‘বিশেষতন্ত্রের’ আগমনের আভাস মেলে। 
স্বাভাবিকভাবেই তীব্র বিরোধিতা আসে বিএনপি এবং সমমনা দলগুলোর দিক থেকে। তাঁরা সংবিধনের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের দাবিতে আন্দোলন, অবেরোধ শুরু করে। দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। নির্বাচনের প্রায় ছয় মাস আগে থেকে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নানাভাবে সমঝোতার উদ্যেগ নেয়। কিন্তু তা সফল হয়নি। শেখ হাসিনাকে একচুল নড়ানো যায়নি। 

তিনি অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ছাড়াই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন করেন। ঐ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোন প্রার্থী ছিলনা। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভোট ছাড়াই ১৫৪ জন এমপি নির্বাচিত হন। বাকি আসন যেগুলোতে নির্বাচন হয়েছিল সেখানেও ভোটারদের উপস্থিতি ছিল একেবারেই নগণ্য। সমালোচনা, বিতর্কের মাঝেই ২০১৪ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি ছিল বহুল বিতর্কিত নির্বাচনগুলোর মধ্যে অন্যতম।
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন আয়োজনের ঠিক দু’মাস পর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় বলেন, ‘জেলা-উপজেলা সদর থেকে অনেক দূরে দূরে ভোটকেন্দ্র হয়। এ কারণে আগের দিন এসব কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স পাঠাতে হয়। এখানে ভোটের দিন সকালে ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স নিয়ে যাওয়া যায় না। কিন্তু যদি ইভিএমে ভোটের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে আর ভোটের আগের দিন রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করার সুযোগ থাকবে না।’ নূরুল হুদার এই বক্তব্যে শেখ হাসিনার অধীনে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোটের আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখার থলের বিড়াল বেরিয়ে এসেছে। 

শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, দেশের সমস্ত জেলা-উপজেলায় একই কাণ্ড ঘটেছে। ১৯৭টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। ১৮৮৯টি কেন্দ্রে পড়েছে ৯৫-৯৯.৯৯ ভাগ ভোট। ভোটের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলেই জালিয়াতির প্রকৃত চিত্র বোঝা যায়। জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন, ‘ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার কথা পৃথিবীর আর কোথাও শুনিনি।’  চরম বিতর্কিত এই নির্বাচনে একচেটিয়া জয়লাভ করে শেখ হাসিনা দ্বিগুন আত্মবিশ্বাস নিয়ে জনগণকে পেছনে ফেলে সরকার গঠন করেন। যে সরকার এখনও জনগণকে শোষণ করছে এবং পরবর্তী নির্বাচন কিভাবে ম্যানিপিউলেশন করবেন হয়তো সেই ফন্দি আঁটছে।