হাসিনা সরকারঘনিষ্ঠ ডিপিডিসির প্রধান প্রকৌশলী মর্তুজার দুর্নীতি যেভাবে ধামাচাপা দেওয়া হয়
জয়নাল আবেদীন
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড স্টোরের প্রধান প্রকৌশলী মর্তুজা কামরুল আলম। শেখ হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী কর্মকর্তা হিসেবে ডিপিডিসিতে যিনি আলোচিত। শুধু তাই নয়, গণমাধ্যমেও সেই আমলে ব্যাপক প্রভাব খাটিয়েছেন তিনি। ক্ষমতার জোর এতটা ছিল যে, দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে কয়েক মাস আগে।
প্রাথমিক তদন্তে তার ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম, অবৈধ সম্পদ গড়াসহ অবৈধ সুবিধা নেওয়ার তথ্যও বেরিয়ে আসে বলে দুদকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সে সময় এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘মর্তুজা কামরুল দুর্নীতি করেছেন- এটা সত্যি, কিন্তু তিনি তো সরকারের (আওয়ামী লীগ সরকার) ঘনিষ্ঠ। ফলে বিষয়টি আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দিকে যাচ্ছে না চূড়ান্তভাবে।’
প্রকৃতপক্ষে ঘটেও তাই, দেশের শীর্ষ সারির একাধিক গণমাধ্যমের অনলাইনে মর্তুজা কামরুলের বিরুদ্ধে ঘুষগ্রহণ ও দুর্নীতির অভিযোগ দুদক অনুসন্ধান করবে বলে খবর প্রকাশ হয়। কিন্তু প্রকাশের এক-দুই ঘন্টার মধ্যেই উচ্চপর্যায়ের তদবিরে অনলাইনে প্রকাশিত রিপোর্ট বন্ধ করতে বাধ্য হয় ওইসব গণমাধ্যম। একটি গণমাধ্যমের অনলাইনে রিপোর্ট প্রকাশের ২২ মিনিটের মাথায় উচ্চপর্যায় থেকে তা বন্ধ করতে তদবির বা চাপ দেওয়ার একটি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন এ প্রতিবেদক।
মর্তুজার বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ায় হওয়ার সুবাদে চট্টগ্রামের এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ও একাধিকবারের মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠতার দাপট দেখাতেন। ওই মন্ত্রী তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকায় গণমাধ্যমে মর্তুজার ক্ষমতা দেখানো সহজ ছিল।
তবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ক্ষমতার পালাবদল হলেও শেখ হাসিনা সরকারের দেওয়া সেই চেয়ারেই বহাল তিনি। দুর্নীতি ও অনিয়মসহ তাকে ঘিরে নানান প্রশ্ন উঠলেও কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেয়নি। হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে পার পেয়ে গেছেন। এখন তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে। এরই মধ্যে নানান মাধ্যমে এ সরকারের ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ার তৎপরতা শুরু করেছেন বলে একটি । এখনো পদপদবি আর পুরোনো প্রকল্পের সেই দায়িত্বেই রয়েছেন, যে প্রকল্প ঘিরে তার বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে।
এ অবস্থায় তৎকালীন সরকারের আমলে ডিপিডিসির কোনঠাসা কর্মকর্তারা প্রশ্ন তুলেছেন যে, ‘এ আমলেও কি মর্তুজা পার পেয়ে যাবেন? এ সরকারের আমলেও কি দুদক ওই প্রকৌশলীর দুর্নীতি ও লুটপাটের তদন্ত শুরু করবে না? এত কিছুর পরেও তিনি বহাল থাকবেন?’
এসব প্রশ্নের ভিড়েও ওইসব কর্মকর্তারা আশা করেন, শুরু হবে মর্তুজার দুর্নীতির বিচার। খুলে যাবে তার মুখোশ।
তার বিরুদ্ধে দুদকে জমা পড়া অভিযোগে বলা হয়, ডিপিডিসিতে রয়েছে প্রধান প্রকৌশলী মর্তুজার দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট। জুরাইনের নির্বাহী প্রকৌশলী আহাম্মেদ শফিকে রমনায় বদলি করা হলেও ১০ লাখ টাকা নিয়ে মর্তুজা তাকে সেখানেই বহাল রাখেন।
একইভাবে আর্থিক সুবিধা নিয়ে জুরাইন থেকে উপ-সহকারী প্রকৌশলী এস.এম কামাল হোসেন এবং উপ-প্রকৌশলী খাইরুল বাশারকে বদলি করা হয়। তাদের কাছ থেকে ১৯ লাখ টাকা নেওয়া হয় বলে ডিপিডিসি সূত্রগুলো জানিয়েছে।
জানা গেছে, মর্তুজা কামরুল আলম জিটুজি প্রকল্পের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকার সুবাদে নিজেই প্রকল্পের বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী পছন্দের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সবরাহ করেন আর্থিক সুবিধা নিয়ে। ক্রয় সংকান্ত বিভিন্ন চুক্তি তিনিই করতেন।
দুদকের ওই অভিযোগে আরও বলা হয়, প্রকল্পের সিএসএস-এ ১৪ ডিভিশনে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে অযোগ্য ঠিকাদারকে কাজ দেন তিনি। ঢাকার একটি অভিজাত হোটেলে হয় লেনদেন। এ নিয়ে সে সময় অন্য ঠিকাদাররা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
অভিযোগে বলা হয়, চট্টগ্রামে আল-ফালাহ হাউজিং সোসাইটিতে ও মিরসরাইতে ৫০ বিঘা জমি রয়েছে তার। ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চলেও রয়েছে প্লট, ফ্ল্যাটসহ অবৈধ সম্পদ।
এসব অভিযোগের বিষয়ে রবিবার ডিপিডিসি কার্যালয়ে এ প্রতিবেদকের কথা হয় মর্তুজার সঙ্গে। তিনি এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিবেন না জানিয়ে বলেন, ‘চা খেতে আসলে আসতে পারেন, কিন্তু বক্তব্য দিবো না।’
ডিপিডিসি ২০১৬ সালে জিটুজি প্রকল্প হাতে নিলেও কাজ শুরু হয় ২০২১ সালে।
এ প্রকল্প ঘিরে মর্তুজার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির বিষয়ে কয়েক মাস আগেও শেখ হসিনা সরকারের তৎকালীন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় অবগত হলেও ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি থেমে যায় দুদকের তদন্তাজও।
২০১৮ সালে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে মর্তুজাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। সেই সময়ে জ্যেষ্ঠতার তালিকার ২০ নম্বরে থাকা মর্তুজাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পদোন্নতি পেয়ে মগবাজার এনওসিএস-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে পদায়ন করা হয় তাকে। জানা যায়, জ্যেষ্ঠতার তালিকা না মেনে নির্বাহী প্রকৌশলীদের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার পর মর্তুজা কামরুল আলমসহ ১২ জনকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে নিয়োগের সুপারিশ করে কমিটি। ডিপিডিসির বোর্ড সভায় তা অনুমোদন দেওয়া হয়।